পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় মনে হতো হাইস্কুল যেন কি না কি। হাইস্কুলে পড়ার যোগ্যতা আমার মনে হয় কোন দিন হবে না।
হাইস্কুলে গেলাম। সাদা শার্ট আর নেভি বুলু প্যান্ট ড্রেসে স্কুলে যেতাম। হাইস্কুল জীবনে পড়াশোনা ছিল ফোর সাব্জেক্ট আর ক্রিকেট, ফুটবল, মার্বেল খেলা ছিল মেইন সাব্জেক্ট। স্কুল পালিয়ে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতে গিয়ে পরের দিন অ্যাসেম্বিলি শেষে শাস্তি স্বরূপ কাঠ পোড়া রোদে সূর্যের দিকে যে কতো তাকিয়ে থাকতে হয়েছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। বৃষ্টি হলেই ক্লাস বন্ধ; এরপর স্কুল বিল্ডিং এর মাঝের দুটো পিলারের মধ্যবর্তী যায়গাটা হয়ে যেতে ফুটবলের বার পোস্ট। আর আমরা হয়ে যেতাম খেলোয়ার। সিরিয়াস চিন্তা ছিল না তখন কোন। মনে হতো হাইস্কুলই অনেক কিছু। কখনো যে কলেজে পড়তে হবে তা মাথার চারপাশে ছিল না। সব সময় ভাবতাম স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এমন ভাবনার পেছনে অবশ্য নিজস্ব কিছু যুক্তি ছিল। ম্যাথে খুব দুর্বল ছিলাম। কিন্তু ইংরেজিতে ভালো ছিলাম। ক্লাস সিক্স থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় গৌরাঙ্গের সাথে চুক্তি করতাম। গৌরাঙ্গ আমাকে পরীক্ষায় ম্যাথ দেখাবে আর আমি ওকে ইংরেজি দেখাবো। জীবনে কখনো ভাবিনি এস.এস.সি পাশ করতে পারবো। কিন্তু এস.এস.সি পরিক্ষার কয়েক মাস আগে নিজের মাঝে আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় স্বপন স্যারের কল্যাণে যে আমি ম্যাথে পাশ করবো। তখনই বোধহয় প্রথম বুঝলাম যে আসলে জীবনে ঠেকে শিখতে হয়।
স্কুল শেষে ভাঙাচোরা রেজেল্ট নিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাও মাথার আশপাশে ছিল না। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পর্বেই মনে হতো এর থেকে ভালো কিছু আমার পক্ষে সম্ভব না। যে অবস্থানে থাকতাম তার পরবর্তী অবস্থানে যাওয়া আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব মনে হতো।
বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পার করে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সুযোগ হলো তখন পড়লাম আর এক চিন্তায়। এতো মানুষের মাঝে হলের সিট পাওয়া এক রকম অসম্ভব মনে হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সিটও পেলাম এবং রাজনীতিতে একটা অবস্থানও পেলাম। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হয় মানুষের বর্তমান অবস্থান থেকে যদি ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি ভাবা হয় তাহলেই বোধহয় এমন হতাশা মাথায় বাসা বাধে। এখন মনে হয় জীবনের কোন কিছুই স্থবির নয়। সব কিছুই পরিবর্তন হতে পারে। যেটি প্রয়োজন তা হলো বর্তমান সময়টিকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমার মনে হয় জীবনে সব সময় পরিকল্পনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তার জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করে সেই সিদ্ধান্তটিকে সঠিক প্রমাণ করতে হয়। এক সময় যা স্বপ্নের মতন ছিল তা এখন হাতের মুঠোয়। আবার এখন যা হাতের মুঠোতে আছে তাও একদিন চলে যাবে। তার মানেতো এই নয় জীবন পড়ে থাকবে।
জীবনের প্রতিটি পর্বের পরে আসবে নতুন পর্ব। সেই নতুন পর্বটিকে আমরা কতোটুকুন নিজের মতন করে সাজাতে পারলাম সেটিই মূল বিষয়। জীবন তরীর কোন পথই সহজ নয়। বাধা থাকবে,বিপত্তি থাকবে থাকবে নানান প্রতিবন্ধকতা। এই সব যারা মানিয়ে নিয়ে চলতে পারে তারা জীবনের কোন না কোন সময় সকল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা লাভ করে বলে আমি মনেকরি। কিন্তু এসব বাধা যারা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয় তারাই আত্মহত্যার মতন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবন তরী থামিয়ে দিয়ে শান্তি খুঁজতে চায়। কিন্তু আসল সুখ কোথায় ? জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে গিয়ে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ভালো থাকার মাঝেই আসল সুখ নিহিত। সুখ শান্তির ব্যাখ্যা নেই। সম্পূর্ণ আপেক্ষিক বিষয়। চাহিদা অনুযায়ী কেউ এক টাকায় খুশি আবার কেউ এক কোটিতে খুশি থাকে না। কেউ রিক্সাচালিয়ে খুশি আবার কেউ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসেও শান্তি পায় না। যেখানে যে অবস্থানে থাকেন না কেন পরিতৃপ্ত হওয়াটা মূল বিষয়। একটা সময় ভেতরে অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাজ করতো। কিন্তু এখন মনে হয় যার জীবনে যে যতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী সে ততো অসুখী মানুষ। এই পৃথিবীতে অনেক বড় অবস্থান নিয়ে বেঁচে থাকাটা যতোটা সহজ একজন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা ঠিক ততোটাই কঠিন। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে তখন একজন মানুষ তার অজান্তেই অসুখী মানুষে পরিণত হতে থাকে। এখন আর হতাশ লাগে না নিজেকে নিয়ে। এখন মনে হয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে যদি কোন কিছু পারবো বলা যায় তাহলে তা করা সম্ভব। যেটি প্রয়োজন তা হলো আবেগকে সাবেক করে কাজ করে যাওয়া। কারন মানুষের জীবনে যতো হতাশা কাজ করে তার পেছনে কোন না কোন ভাবে আবেগ জড়িত থাকে বলে আমার মনে হয়। রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে আবেগ থাকবে। কিন্তু আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে নেই এবং সব আবেগ প্রকাশ করতে নেই। পৃথিবীর সব থেকে ধনী মানুষটিও বোধহয় জীবনের শেষ দিনটায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে শান্তির খোঁজ করে যা সে কোন দিন অর্থ বিত্ত দিয়ে কিনতে পারেনি।
শ্রাবন্য সায়ান শান্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Comment Now